অবন্তির সাথে একরাত

(দ্বিতীয় পর্ব)

অবন্তিকার সাথে পরিচয় ২০১২ সালের কোন এক বৃষ্টিস্নাত রাতের ময়মনসিংহের ঈশ্বরগঞ্জে, তখন আমি ময়মনসিংহ থেকে কিশোরগঞ্জ যাচ্ছিলাম আর অবন্তিকা ছিলো রোড এক্সিডেন্টে মারা যাওয়া এক অদ্ভুত রূপবতী। সেই অদ্ভুত রূপবতীকে প্রথমে মানুষ মনে করলেও সেই ভুলটা বুঝতে পারি পরেরদিন সকালে। এতকিছুর পরও কখনো অবন্তির উপর ভয় কাজ করেনি, হয়েছিল প্রণয় আর অপেক্ষায় ছিলাম যদি কখনো আবার হয় দেখা…


দেখা হয়নি আর অবন্তিকার সাথে নির্জন কোন অন্ধকার রাস্তায়, ব্যাঙ ডাকা বৃষ্টির রাত্রিরে, তবে প্রায় বৃষ্টিতেই ভাবতাম আসবে কি অবন্তি? সে তো কথা দিয়েছিলো আবার দেখা হবে, অপেক্ষায় থাকবে সে!


কর্মব্যস্ততায় অবন্তির কথা প্রায় ভুলেই গিয়েছিলাম কিন্তু মাঝরাত্রিতে যা দেখলাম তা কোন ভাবেই বিশ্বাস করতে পারছি না, স্ত্রীকে খুলে বললাম সব কিছু। স্ত্রী বিয়ের আগেই জানতো অবন্তিকার কথা, সে অবন্তিকাকে নিয়ে লেখাটাও পড়েছিল এবং আমার মনের ভুল কল্পনা বৈকি কিছুই ভাবে নি; আজও তেমনি ভাবছেআমি স্ত্রীকে বললাম অবন্তিকা সত্যিই এসেছিলো রাতে, আমার বালিশের পাশে বসেছিলো, মাথায় হাত বুলাতেই ঘুম ভেঙে যায় আমার, অনেকক্ষণ গল্প ও হয়েছে অবন্তিকার সাথে, তোমাকেও অনেক ডেকেছি পরিচয় করিয়ে দেয়ার জন্য কিন্তু তুমি উঠোনি, গভীর ঘুমে নিমগ্ন ছিলে।


স্ত্রী হেসে উড়িয়ে দিয়ে বললো এটা তোমার ভ্রান্ত ধারণা, প্রচন্ড গল্পের বই পড়ার এই হলো আরেকটা সমস্যা; আমি বারবার করে বললাম সত্যিই এসেছিলো সে ঠিক ততবারই বললো দুঃস্বপ্ন। মনস্থির করলাম ডাক্তার দেখানো হবে আমার, এপয়েনমেন্ট নিয়ে ডাক্তার কে খুলে বললাম অবন্তিকার গল্প, আমাদের প্রেম ও ভালোবাসার গল্প।
ডাক্তার বললেনঃ অবন্তিকা কি ড্রেস পড়ে এসেছিলেন?

আমি বললামঃ লাল জামা

ডাক্তারঃ আপনি নিশ্চয় জানেন স্বপ্ন সবসময় হয় সাদা- কালো আর আপনি দেখেছেন লাল!

আমিঃ আমি তো স্বপ্ন দেখিনি, আমি দেখেছি বাস্তব

ডাক্তারঃ আমি সেজন্যই বলছি, ফ্রয়েড পড়েছেন?

আমিঃ না

ডাক্তারঃআমাদের মনকে ৩ টি ভাগে ভাগ করা হয়, প্রথম ভাগ হলো আন কনশাস, কনশাস এবং তৃতীয় ভাগ হলো সাব-কনশাস। আমাদের ঘুম ও এই তিন রকমের ভেতর দিয়ে যায়। ঘুমের শুরু বা শেষের দিকে আমরা সাব-কনশাস বা বাংলায় যাকে অবচেতন মন বলি সেটার মধ্যে দিয়ে যায়। আর আমরা যখন গভীর ঘুমে থাকি ধরেন মধ্যরাত্রি বা অতিরিক্ত টায়ার্ড তখন আন কনশাস মাইন্ডে থাকি। আর স্বপ্ন যখন দেখি তখন আমরা থাকি সাব কনশাস স্টেজে। এবার বলুন আপনি অবন্তিকাকে কখন দেখেছেন?

আমিঃ মধ্যরাত থেকে ভোররাত্রীর আগ পর্যন্ত।

ডাক্তারঃ আপনি স্বপ্ন দেখেছেন কারণ এই অবন্তিকা গল্পটা আপনার মনে দাগ কেটে রেখেছে। অবন্তি নামে সত্যিই কেউ আছে নাকি সম্পূর্ণটাই আপনার মনের কল্পনা সেটা আপনার পরিষ্কার হওয়া উচিৎ তবে মেডিকেল সায়েন্সে আত্মা বা এসব গল্পের স্থান নেই তাছাড়া আপনার যে ঠিকমতো ঘুম হয়নি সেটা আপনার চেহারাতেই বুঝা যাচ্ছে, মুখটা খুবই শুকনো ও অনেকটা টায়ার্ড দেখাচ্ছে। এনিওয়ে আপনাকে কয়েকটা ঔষধ লিখে দিচ্ছি প্রতিদিন নিয়ম মেনে খাবেন। আমি ধন্যবাদ বলে চেম্বার থেকে বের হয়ে আসলাম।

অবশ্য যাওয়ার আগে ডাক্তার এমন কিছু বলবে সেটা আমার এক্সপেক্টেশন ছিলো। আমি ঔষধ কিনে বাসায় ফিরেছি কিন্তু মনকে কোন ভাবেই বুঝাতে পারছিনা যে যা দেখেছি সেটা অলীক কোন গল্প! আমি কি তাহলে মানুষিক অবসাদগ্রস্ত? তাহলে অবন্তির সাথে পরিচয়, সেই গাছতলা? ওর বাবার সেই কান্না? না আমি যা দেখেছি তা কখনোই কোন গল্প কিংবা কল্পনা হতে পারে না।


ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী ঔষধ খেয়ে রাতে ঘুমানোর প্রস্তুতি নিয়েও ঘন্টা দুয়েক পার হয়ে যাওয়ার পর নিজেকে সত্যিই ইনসমনিয়ার রোগি মনে হচ্ছে কারণ ডাক্তার তার প্রেসক্রিপশনে পর্যাপ্ত স্লিপিং পিল লিখেছেন।

চিন্তা করতে করতে সেদিন ঘুমিয়ে গিয়েছিলাম এবং ঘুম ভেঙ্গেছে সকাল ৮ টাই। করোনা কালীন লকডাওন চলছে তাই ওয়ার্ক ফ্রম হোম;ফ্রেশ হয়ে তড়িঘড়ি করে ল্যাপটপ অন করলাম। গুগুল সার্চ দিলাম “রোড এক্সিডেন্ট – অবন্তিকা, ঈশ্বরগঞ্জ, ময়মনসিংহ, সিলেট” সম্ভাব্য সবরকম কি ওয়ার্ড ইউজ করেছি। জাতীয় কিছু সংবাদপত্র লিংক দেখে ক্লিক করলাম অবন্তিকা, হ্যা অবন্তিকার ছবি, আমার অবন্তির ছবি! লাল জামা রক্তাক্ত চেহারা, সেই চেনা মহাসড়ক!


আমি বিষ্মিত হইনি কারণ আমি জানি সেই প্রেম, কথোপকথন কখনো মিথ্যা হতে পারে না ; কেউ বিশ্বাস করুক বা না করুক আমি অবন্তিকে চিনি, ওকে স্পর্শ করেছি, স্পর্শ মিথ্যে হবার নয়। সেদিনের মতো অফিশিয়াল কাজ সেরে সন্ধ্যায় টরেন্ট থেকে মৃত মানুষ, আত্মা সংক্রান্ত কিছু বই ডাওনলোড করলাম।

সেই আত্মা নিয়ে নানান অভিমত, একদল বিশ্বাস করছে আত্মা বলে কিছু নেই, এসব ভিত্তিহীন ভ্রান্ত ধারণা আর আরেকদল বিশ্বাস করে আত্মা অবিনশ্বর, আত্মাকে আগুনে পোড়ানো যায়না, ছুড়িতে কাটা যায় না, পানিতে দ্রবীভূত করা যায় না, আত্মা অলৌকিক কিছু কেবল দেহ বদলায় যেমন মানুষ পুরাতন কাপড় বদলে নতুন কাপড় পরিধান করে। আমার অভিজ্ঞতার সাথে রিলিভ্যান্ট দ্বিতীয় অভিমত তাই চয়েসের দিক থেকে দ্বিতীয় অপশন বাছাই করাই যুক্তিযুক্ত মনে হলো। কারণ মানুষ সেটিই সিলেক্ট করে যদি সে রিলিভেন্ট কিছু পেয়ে থাকে সেদিক থেকে আমিও তার ব্যতিক্রম না।


মানুষিক একটা প্রশান্তি নিয়ে সন্ধ্যাটা পার হয়েছে, শুধু তাই নয় নিজেকে সুস্থ মনে হয়ে মনটাও হাসিখুশি।


মধ্যরাত, জানালা খোলা, দমকা হাওয়া আর গুড়িগুড়ি বৃষ্টি – আমি আর আমার স্ত্রী ঘুমাচ্ছি।
কানে মৃদুস্বরে ডাক আসলো “সৈকত ঘুমিয়েছ? সৈকত? “আচমকা ঘুম ভাঙলো ,স্ত্রীর দিকে তাকালাম সে গভীর ঘুমে নিমজ্জিত, তাই ভ্রান্ত না হয়ে ঘুমানোর চেষ্টা করলাম। জানালার পর্দা বাতাসে প্রচন্ডভাবে উড়ছে এতে ঘুমের ও ব্যাঘাত ঘটছে তাই জানালাটা বন্ধ করার জন্য গ্লাসটা টানতেই বেলকনিতে লাল জামা পড়া মেয়ে বসে;তখনো ভয় পাইনি


ডাকলামঃ অবন্তি? ডাকতে ডাকতে বেলকনিতে রাখা চেয়ারটার পাশে দাড়ালাম

অবন্তিঃ বিরক্ত হয়েছ বাসায় এসেছি বলে?

আমিঃ আমতাআমতা করে বললাম নাহ তা না

অবন্তিঃ আমি জানি, আমাদের দেখা করার কথা ছিল সেই চিরচেনা মহাসড়কে; কতযে অপেক্ষা করেছি তোমাকে দেখবো বলে কিন্তু তুমি আর আসোনি

আমিঃ হ্যাঁ আমি ২০১৩ থেকে ঢাকায় শিফট হয়েছি তাই ঈশ্বরগঞ্জ আর যাওয়া হয়ে উঠেনি; কেমন আছো অবন্তি?

অবন্তিঃ যেমন ছিলাম; তোমাকে দেখার বড্ড অসুখ হয়েছিলো তাই নিজেকে কন্ট্রোল করতে পারিনিআমিঃ ভালোই করেছো এসে, হাত দিয়ে মুখটা স্পর্শ করলাম অবন্তির যেনো চাঁদ তার চেহারার কাছে হার মানবে।

অবন্তিঃ তোমার স্ত্রী শ্রাবন্তী কেমন আছে? খুব ভালবাসো শ্রাবন্তীকে?

আমিঃ আমতাআমতা করে কিছু বলার আগেই

অবন্তি বললোঃ তুমি মানুষ আমি শূন্য, এটাই স্বাভাবিক।

চারদিকে নিস্তব্ধতা, দুজন বেলকনির গ্রিল দিয়ে আকাশে বৃষ্টির দিকে তাকিয়ে রইলাম কিছুক্ষণ। স্তব্ধতা ভেঙে অবন্তি বললো তোমার হাতটা দাও। আমি বাড়িয়ে দিলাম, অবন্তি তার দুহাত দিয়ে আমার দুহাত স্পর্শ করে কপালে চুমু খেলো, আমি অপরাধীর মতো বিষ্ময় নিয়ে তাকিয়ে রইলাম অবন্তির দুচোখে।


ঘুম ভাঙলো, বেলকনির চেয়ারে, শ্রাবন্তী তখনো ঘুমাচ্ছে। আজ নিজেকে খুবই অসহায় মনে হচ্ছে,খুবই অসহায়। ল্যাপটপ নিয়ে কাজে বসলাম, শ্রাবন্তী চা’য়ের কাপ নিয়ে বসলো আমার পাশে, এক কাপ চা এগিয়ে দিয়ে বললো – অবন্তিকে খুব ভালবাসো তুমি?


আমি উত্তর দিতে পারলাম না, তার চোখেও অবাক নয়নে তাকিয়ে রইলাম;

কেমন মায়াভরা চোখ

শ্রাবন্তীঃ অবন্তি এতটা সুন্দর হবে আমিও ভাবিনি কখনো, এতটা মায়া থাকবে দু চোখ ভরা

আমিঃ তুমি দেখেছ অবন্তিকে?

শ্রাবন্তীঃ এই শ্রাবণে একটা লালশাড়ি কিনে দিবে আমায়? আমি আর তুমি শ্রাবণে বৃষ্টিস্নাত রাতে অবন্তিকে দেখতে যাবো ঈশ্বরগঞ্জে?

আমি লক্ষ্য করলাম শ্রাবন্তীকে তার মায়াভরা চোখে অসম্ভব রূপবতী লাগছে

শ্রাবন্তী এবার বললোঃ আমাকে অবন্তির মতো মায়াবতী দেখাচ্ছে না? বলেই মৃদু হাসলো শ্রাবন্তী!